কখনো কি গভীর সমুদ্রে ডুব দেওয়ার ইচ্ছে হয়েছে? বিশাল জলরাশির নিচে রঙিন মাছের মিছিল, ভয়ঙ্কর হাঙরের রাজত্ব আর রহস্যময় সামুদ্রিক প্রাণীদের এত কাছ থেকে দেখার স্বপ্ন দেখেছেন?
যদি উত্তরের ঝাঁপি খুলে যায় “হ্যাঁ”-তে, তবে আপনার স্বপ্নের দুয়ার খুলতে চলেছে কক্সবাজারের রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড (Radiant Fish World)! সমুদ্রের নিচে নামার প্রয়োজন নেই, কারণ এখানে আপনি কাঁচের একুরিয়ামের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে যেতে পারবেন রহস্যময় এক জলের রাজ্যে। চারপাশে নীলাভ আলো, রঙিন প্রবাল, আর জলজ প্রাণীদের সৌন্দর্যে আপনি হারিয়ে যাবেন যেন অন্য এক গ্রহে! সমুদ্রের নীল জলে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় জগৎ, রঙিন মাছের খেলা, শিকারি হাঙরের গা শিউরানো উপস্থিতি—এসব সাধারণত গভীর সমুদ্রে গিয়ে কল্পনার চোখে দেখার বিষয়। কিন্তু রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড সেই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এই একুরিয়াম পার্ক শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং এটি এক বিস্ময়কর শিক্ষাকেন্দ্রও, যেখানে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যে কেউ জানতে পারে সামুদ্রিক জীবনের বৈচিত্র্য ও পরিবেশগত গুরুত্ব। কক্সবাজারের সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন পেরিয়ে যখন রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডে (Radiant Fish World) প্রবেশ করবেন, তখনই অনুভব করবেন এক রোমাঞ্চকর অভিযানের শুরু। চলুন, এবার ঘুরে দেখা যাক, কী কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে আপনার জন্য!
রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড (Radiant Fish World): এক নজরে

বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার শুধু তার দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং এখানে অবস্থিত রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড (Radiant Fish World) এক অনন্য আকর্ষণ হিসেবে পর্যটকদের মুগ্ধ করে। ২০১৮ সালে চালু হওয়া এই বিশাল একুরিয়ামটিতে দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী রাখা হয়েছে, যা দর্শকদের এক নতুন জগতে নিয়ে যায়।
পুরো রেডিয়েন্ট ফিশ একুরিয়াম কমপ্লেক্সটিকে সর্বমোট ৮টি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এসব জোনে রয়েছে থ্রি ডি জোন, দেশি বিদেশি নানান প্রজাতির মাছ, ছবি তোলার আকর্ষণীয় ডিজিটাল কালার ল্যাব, কেনাকাটা করার জন্য অনেক দোকান, লাইভ ফিশ রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি রয়েছে। পুরো কমপ্লেক্সটি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় রয়েছে।
এখানে ২০০-এর বেশি প্রজাতির সামুদ্রিক ও মিঠাপানির মাছ রয়েছে। বিশেষ করে রঙিন প্রবাল, শিকারী মাছ, বিশালাকৃতির ক্যাটফিশ, স্টারফিশ ও অক্টোপাস দর্শনার্থীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।
প্রবেশের সাথে সাগরতলের অনুভূতি
রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডে প্রবেশের পরই দর্শনার্থীরা অনুভব করেন এক মায়াবী জলজ রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। স্বচ্ছ কাচের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হবে, বিশাল সব মাছ ও জলজ প্রাণীরা যেন চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানকার ৩৬০-ডিগ্রি পানির সুড়ঙ্গ পথ (Underwater Tunnel) সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ, যেখানে দাঁড়িয়ে বিশাল আকৃতির হাঙ্গর বা রঙিন মাছের ঝাঁক দেখতে পাওয়া যায়।
রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডের বিশেষ আকর্ষণ

১. একুরিয়ামের বিস্ময়কর জলজ প্রাণী
রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড (Radiant Fish World) এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর ব্যতিক্রমী জলজ প্রাণী সংগ্রহ। এখানে দেখা যাবে—
- শিকারী পিরানহা: দক্ষিণ আমেরিকার ভয়ঙ্কর কিন্তু রহস্যময় মাছ, যারা তাদের তীক্ষ্ণ দাঁতের জন্য পরিচিত।
- লোভনীয় ক্লাউন ফিশ: জনপ্রিয় অ্যানিমেটেড সিনেমা ‘ফাইন্ডিং নেমো’র জন্য বিখ্যাত এই ছোট মাছগুলো দর্শকদের বেশ আকৃষ্ট করে।
- স্টিংরে বা শাপলাপাতা মাছ: যারা দেখতে সমতল এবং পানির নিচে উড়তে থাকা বিশালাকার ডানার মতো অনুভূতি দেয়।
- সাগরের রাজা হাঙর: যাকে কাছ থেকে দেখা সত্যিই শিহরণ জাগানো এক অভিজ্ঞতা।
- অদ্ভুতাকার অক্টোপাস: যার প্রতিটি নড়াচড়া ও রঙ পরিবর্তনের ক্ষমতা দর্শকদের অবাক করে।
২. ৩৬০-ডিগ্রি পানির সুড়ঙ্গ (Underwater Tunnel)

এই সুড়ঙ্গ পথটি রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডের অন্যতম বড় চমক। পানির নিচে কাঁচের সুড়ঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে আপনি গভীর সমুদ্রের ভেতর দিয়ে হাঁটছেন, যেখানে চারপাশে ঘুরছে রঙিন মাছ, স্টিংরে ও হাঙরের মতো ভয়ঙ্কর শিকারি।
৩. ইন্টারেকটিভ টাচ ট্যাঙ্ক : যেখানে প্রাণীদের ছোঁয়া যাবে
এটি বিশেষভাবে শিশুদের জন্য উপযোগী। শুধু দূর থেকে দেখা নয়, রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডে দর্শনার্থীরা কিছু নির্দিষ্ট জলজ প্রাণীর সংস্পর্শেও আসতে পারেন। টাচ ট্যাঙ্কে রাখা রয়েছে ছোট স্টারফিশ, কচ্ছপ ও নিরীহ কিছু সামুদ্রিক প্রাণী, যেগুলোর গায়ে আলতো ছোঁয়া দেওয়া যায়। এটি শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক ও মজার অভিজ্ঞতা।
৪. কিডস কর্নার এবং শিক্ষা কেন্দ্র
শিশুদের জন্য এখানে রয়েছে বিশেষ লার্নিং জোন, যেখানে তারা মাছ সম্পর্কে শিখতে পারে, একুরিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণের কৌশল জানতে পারে এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। এটি শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় ও বিনোদনমূলক একটি অভিজ্ঞতা।
৫. ফটোগ্রাফির জন্য দারুণ লোকেশন

আলোকসজ্জা, কাঁচের পানির সুড়ঙ্গ এবং রঙিন মাছের ঝাঁক একে নিখুঁত ফটোস্পট বানিয়েছে। পর্যটকদের জন্য এটি স্মৃতিময় মুহূর্ত ধরে রাখার এক অসাধারণ স্থান।
রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড (Radiant Fish World) কেন ভ্রমণ করবেন?
- পরিবার ও শিশুদের জন্য আদর্শ জায়গা
সাধারণত একুরিয়ামগুলো শিশুদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়। রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডেও রয়েছে শিশুদের জন্য নানা ধরনের এক্সপেরিয়েন্স জোন, যা তাদের আনন্দের পাশাপাশি জ্ঞানও বাড়ায়।
- অভিজ্ঞতার নতুন মাত্রা
কক্সবাজারে সাধারণত পর্যটকরা সৈকতে সময় কাটান, তবে একবার রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ করলে সমুদ্রের সৌন্দর্য এক নতুন মাত্রা পায়।
- ছবির জন্য দারুণ লোকেশন
এই একুরিয়ামের আলোকসজ্জা, রঙিন মাছ এবং পানির নিচের সুড়ঙ্গ এতটাই নান্দনিক যে এখানে ছবি তুলতে যেকোনো পর্যটকই আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
- নতুন কিছু শেখার সুযোগ
শুধু বিনোদন নয়, এখানে দর্শনার্থীরা বিভিন্ন জলজ প্রাণীর জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে পারবেন, যা শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।
কিভাবে যাবেন?
- বিমান: ঢাকা থেকে কক্সবাজারের সরাসরি ফ্লাইট রয়েছে।
- ট্রেন: চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে তারপর বাস বা মাইক্রোবাসে কক্সবাজার পৌঁছানো যায়। অথবা সরাসরি ঢাকা থেকে ট্রেনে কক্সবাজার পর্যন্ত যেতে পারেন।
- বাস: ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বড় শহর থেকে কক্সবাজারের সরাসরি এসি ও নন-এসি বাস সার্ভিস রয়েছে।
রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড কক্সবাজার শহরের সুগন্ধা পয়েন্টের খুব কাছেই অবস্থিত, তাই সৈকত ঘুরে সহজেই এখানে যাওয়া যায়। কক্সবাজার এসে সমুদ্রে ঘুরাঘুরি করে অনায়াসেই সিএনজি/ইজিবাইক/অটোরিকশায় ঝাউতলা গিয়ে, পৌষী রেস্টুরেন্টের সামনে মোড় ঘুরে হাতের বামপাশে অল্প কয়েক কদম গেলেই পাবেন ফিশ ওয়ার্ল্ড।
রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড ভ্রমণের তথ্য
- অবস্থান: ঝাউতলা, প্রধান সড়ক, কক্সবাজার।
- খোলা থাকার সময়: সকাল ৯:০০ থেকে রাত ১০:০০ পর্যন্ত।
- টিকিট মূল্য:
- প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য: ৩০০ টাকা।
- শিশুদের জন্য: যাদের উচ্চতা ৩ফুট ৬ইঞ্চির নিচে, তাদের প্রবেশ সম্পুর্ন ফ্রি।
- বিশেষ ছাড়: দলগত দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ ডিসকাউন্ট রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষ্যে ৫-১০% ডিসকাউন্ট থাকে।
কিছু প্রয়োজনীয় টিপস
- সকাল বা বিকেলের দিকে গেলে ভিড় কম পাওয়া যাবে, যা আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য ভালো।
- ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা বা ভালো মানের স্মার্টফোন সঙ্গে নেওয়া উচিত।
- শিশুদের নিয়ে গেলে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন এবং টাচ ট্যাঙ্কে হাত দেওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন।
- জায়গাটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় হালকা গরম কাপড় নিতে পারেন।
রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড (Radiant Fish World) শুধুমাত্র একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এখানে প্রবেশ করা মানেই এক মুহূর্তের জন্য সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া। শিশুদের শেখার সুযোগ থেকে শুরু করে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী—সবই আছে এখানে। কক্সবাজার গেলে শুধু সৈকত ভ্রমণের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড এমন একটি জায়গা, যেখানে জলজ জীবনের অপরূপ সৌন্দর্য, অ্যাডভেঞ্চার, এবং শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা একসঙ্গে পাওয়া যায়।
তাই কক্সবাজার গেলে সৈকতের পাশাপাশি এই অনন্য জলজ জগত ঘুরে আসার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না!
আপনি কি রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডে গিয়েছেন? আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? কমেন্টে জানান!
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড (Radiant Fish World) কোথায় অবস্থিত?
উত্তর: এটি কক্সবাজারের ঝাউতলা, প্রধান সড়কে অবস্থিত, যা শহরের কেন্দ্র থেকে সহজেই যাওয়া যায়।
২. একুরিয়ামে কী ধরনের মাছ ও জলজ প্রাণী দেখা যাবে?
উত্তর: এখানে ২০০+ প্রজাতির মাছ রয়েছে, যার মধ্যে হাঙর, স্টিংরে, পিরানহা, ক্লাউন ফিশ, অক্টোপাস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
৩. টিকিটের মূল্য কত?
উত্তর: প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৩০০ টাকা। শিশুদের জন্য যাদের উচ্চতা ৩ফুট ৬ইঞ্চির নিচে, তাদের প্রবেশ সম্পুর্ন ফ্রি।
৪. ভ্রমণের জন্য কোন সময়টা সবচেয়ে ভালো?
উত্তর: সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা বা বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত গেলে কম ভিড় পাবেন এবং ভালোভাবে ঘুরতে পারবেন।
৫. এখানে কি খাবার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে?
উত্তর: হ্যাঁ, এখানে ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে, যেখানে পর্যটকরা খাবার ও পানীয় উপভোগ করতে পারেন।
৬. রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড কতক্ষণ সময় ধরে ঘুরতে পারবো?
উত্তর: গড়ে ১.৫-২ ঘণ্টা লাগতে পারে পুরো একুরিয়াম ঘুরতে।