১) প্যারাসেলিংয়ের (Parasailing) সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
প্রথম ব্যবহারিকভাবে প্যারাসুট আবিষ্কার করেন সেবাস্তিয়ান লেনরম্যান্ড। ১৭৮৩ সালে তিনি এটি প্রথম প্রদর্শন করেন। তবে তারও বহু শতাব্দী পূর্বে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি প্যারাসুটগুলো স্কেচ করেছিলেন। এছাড়া ফ্রান্সের কর্নেল মিশেল টুর্নিয়ে প্রথম ট্রাক টেনে প্যারাসুট নিয়ে উড়ে যান। ১৯৬০ এর দশকে ফ্রান্সে এটিকে বিনোদনের অংশ হিসেবে জনপ্রিয় করা হয়।
২) প্যারাসেলিং- এ স্থান নির্বাচন
বাংলাদেশের শুধুমাত্র দুটি স্থানে অর্থাৎ কক্সবাজারের দরিয়ানগর ও হিমছড়ি এলাকায় চমৎকার প্যারাসেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। কক্সবাজার শহর থেকে ৬ কি.মি রাস্তা অতিক্রমের পর হিমছড়ি দরিয়ানগর পয়েন্টের দেখা মিলবে। যেখানে রয়েছে মেরিন ড্রাইভ রোড এবং এর দক্ষিণ পাশেই প্যারাসেলিংয়ের সুব্যবস্থা। দরিয়ানগর “স্যাটেলাইট ভিশন সী স্পোর্টস” এবং হিমছড়িতে ‘ফানফেস্ট’ নামে একই মালিকের অধীনে দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা প্রতিদিন আগ্ৰহী পর্যটকদের রোমাঞ্চে ভেসে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ করে দিচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০-৫০০ ফুট উঁচুতে উঠে আপনি এই রোমাঞ্চের সাক্ষী হতে পারেন, যেখানে ৫-১২ মিনিট শূন্যে ভেসে নীলাভ পানি আর নীল গগনের গভীর মিতালী উপভোগ করা যায়। পাখির চোখে দেখতে পাবেন সারিবদ্ধ দানব সবুজ পাহাড়ের অবিচল স্থিরতা আর বিশাল ঝাউবন যেন এক চিলতে জমি।
৩) অন্য আকর্ষণ
প্যারাসেলিংয়ের পাশাপাশি যদি সমুদ্র এলাকার আশপাশের দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা যায়, তবে আপনার ভ্রমণের ষোলকলা পূর্ণ হবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলাই যায়। দরিয়ানগর থেকে সামান্য হাঁটলেই বড়ছেঁড়া গ্ৰাম, পাহাড়, একাধিক ঝর্না ও আদি গুহা ঘুরে দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে কয়েকশো বছরের সুড়ঙ্গ পথ। হিমছড়িতে যাওয়ার পথে বামদিকে সবুজের হাতছানি আর ডানদিকে নীলের হাতছানি বলছি পাহাড় আর সমুদ্রের কথা। বর্ষায় হিমছড়ির ঝর্ণা হয়ে ওঠে আরো চঞ্চলা, চপলা এবং মনোমুগ্ধকর। হিমছড়ির পাহাড়ের চূড়ায় বসে গ্ৰাম ও সমুদ্রকে একসঙ্গে দেখতে হলে অতিক্রম করতে হবে শত শত সিঁড়ি। এছাড়া অবকাশযাপনের জন্য এখানে রয়েছে বেশকিছু পর্যটনকেন্দ্র ও পিকনিক স্পট।
৪) ব্যয়ভার:
স্যাটেলাইট ভিশন সী স্পোর্টসে (দরিয়ানগর) ওড়ার ৩ টি প্যাকেজ রয়েছে।
১) ১৫০০ টাকা: প্যারাসেলিং এর সর্বনিন্ম খরচ। যেখানে শুধুই উড়তে পারবেন এবং যথাসময়ে অবতরণ।
২)২০০০ টাকা: এই সুপার রাইডে ওড়ার মধ্যপথে সাগরে আলতো পা ভিজিয়ে পুনরায় শূন্যে ভাসার সুযোগ।
৩) ২৫০০ টাকা: সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ এই খরচে আপনি দুইবার সমুদ্রে অবতরণ করে পা ভেজানোর সুযোগ পাবেন। যা “সুপার ডুপার” রাইড নামে পরিচিত।
আর “ফানফেস্টে” রয়েছে রাইডে চড়ার দুটি প্যাকেজ। সর্বনিন্ম ১৫০০ এবং সর্বোচ্চ ২০০০।
৫)প্যারাসেলিংয়ের উপযুক্ত সময়:
🔷 ঋতু অনুসারে উপযুক্ত সময়
শুক্লা ও শরৎকাল (অক্টোবর থেকে মার্চ): এই সময় কক্সবাজারের আবহাওয়া সবচেয়ে মনোরম ও স্থির থাকে। আকাশ পরিষ্কার থাকে, বাতাসের গতি নিয়ন্ত্রণে থাকে, ফলে প্যারাসেইলিংয়ের জন্য এটি সেরা সময়।
গ্রীষ্মকাল (এপ্রিল থেকে জুন): গরম থাকলেও সকালে প্যারাসেইলিং করা যায়, তবে দুপুরের পর গরম ও আর্দ্রতা বেশি থাকে, তাই বিকেলে ঝড়-ঝাপটা হতে পারে।
বর্ষাকাল (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর): বর্ষাকালে ভারী বৃষ্টি ও ঝড়ের কারণে প্যারাসেইলিং করা নিরাপদ নয়। এই সময় এড়িয়ে চলাই ভালো।
🔷দিনের নির্দিষ্ট সময়
সকাল ১০টা থেকে দুপুর ৩টা: এই সময় আবহাওয়া সাধারণত স্থির থাকে, বাতাসের গতি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাই প্যারাসেইলিং উপভোগ করা যায়।
বিকেল ৪টা থেকে সূর্যাস্ত: বিকেলের আলো ও সমুদ্রের রঙিন দৃশ্য প্যারাসেইলিংয়ের আনন্দ দ্বিগুণ করে। তবে সন্ধ্যার পর বাতাসের গতি বাড়তে পারে, তাই সতর্ক থাকতে হবে।
৬)আবহাওয়া ও নিরাপত্তা
🔹প্যারাসেইলিং করার আগে অবশ্যই স্থানীয় অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবহাওয়ার অবস্থা যাচাই করুন।
🔹ঝড়, বজ্রপাত, ভারী বৃষ্টি বা প্রবল বাতাসের সময় প্যারাসেইলিং করা থেকে বিরত থাকুন।
🔹নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট ও সেফটি গিয়ার ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
৭)অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
🔹প্যারাসেইলিংয়ের জন্য হালকা পোশাক পরিধান করুন যা বাতাসে সহজে চলাচল করতে সাহায্য করে।
🔹ক্যামেরা বা মোবাইল ফোন নিয়ে প্যারাসেইলিং করার আগে অপারেটরের অনুমতি নিন বা বডি মাউন্টেড ক্যামেরা ব্যবহার করুন।
🔹প্যারাসেইলিং শেষে নিরাপদে নেমে সাহায্যকারী কর্মীদের ধন্যবাদ জানাতে ভুলবেন না।
৮) সতর্কতা:
- দক্ষ অপারেটর দ্বারা পরিচালিত এবং যারা আরোহীকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে প্যারাসেলিংয়ের ব্যবস্থা করে , এমন প্রতিষ্ঠানকে প্যারাসেলিংয়ের জন্য বেছে নিবেন
- প্যারাসেলিংয়ের সম্ভাব্য সব ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর আরোহণ করুন। হুজুগের বশে আরোহণ করবেন না।
- জোয়ারের সময় স্পিডবোট ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলাতে ব্যর্থ হয়। তাই এসময় প্যারাসেলিংয়ের চিন্তা বর্জন করুন।
- প্যারাসুটে ওঠার আগে স্পিডবোট ও যাবতীয় সরঞ্জাম ভালোভাবে যাচাই করে নিন। ভেজা প্যারাসুটে আরোহণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই শুকনো প্যারাসুটে আরোহণ করুন এবং অবশ্যই দড়ি যাচাই করে নিন।
- স্পিডবোটে পর্যাপ্ত তেল আছে কিনা যাচাই করে নিন। পরিমাণে তেল কম হলে প্যারাসেলিংয়ের মধ্য পথে আপনাকে সমুদ্রে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ভিজতে হবে।
- যদি দুর্ভাগ্যবশত কোন কারণে সমুদ্রে পড়ে যান তবে আতঙ্কিত হবেন না। প্যারাসেলিংয়ের কর্মীরা আপনাকে উদ্ধার করবে এবং সাঁতার না জানলে হাত উঁচু করে সংকেত দিবেন। আর যদি সাঁতার জেনে থাকেন, তাহলে খেয়াল রাখবেন দড়ি যেন আপনার পায়ের সঙ্গে না পেঁচিয়ে যায়।
- অবশ্যই প্যারাসেলিং আগে লাইফ জ্যাকেট পড়ে নিবেন।
৯) কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি ও দড়িয়ানগর যাওয়ার সহজ উপায়:
কক্সবাজার শহর থেকে দরিয়ানগর ও হিমছড়ি মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে সহজে পৌঁছানো যায়। হিমছড়ি কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভের অন্য একটি জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা, যা দরিয়ানগরের কাছাকাছি। স্থানীয় ট্যাক্সি, সিএনজি অটো রিকশা বা বাসে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে সহজেই যাওয়া যায়।
১০) কক্সবাজার বিমানবন্দর যাত্রা:
কক্সবাজার বিমানবন্দর হয়ে আসা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আরো এক রোমাঞ্চের নাম। ১৪০০ মিটার উঁচু থেকে নীল অর্ণবের বিশাল জলরাশি আর বালুকাময় বেলাভূমি যেন একটুকরো স্বর্গ। এটি বাংলাদেশের ৪র্থ বিমানবন্দর হিসেবে জুলাই ২০২৫ থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করবে। এই বিমানবন্দরের রানওয়ে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ যার কিছু অংশ বঙ্গোপসাগরের উপর নির্মিত। নতুন আধুনিক আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবন নির্মাণাধীন, যা বড় ধরনের বিমান পরিচালনায় সক্ষম হবে এবং কক্সবাজারকে আঞ্চলিক পর্যটনের একটি হাব হিসেবে গড়ে তুলবে।সরকার কক্সবাজারকে ইন্দোনেশিয়ার বালির মতো একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে, যা পর্যটকদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
তাই এই গরমে যাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, বিলম্ব না করে তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে আসুন প্রশান্তির নীড়ে, সাথে থাকবে রোমাঞ্চ আর কিছু ব্যথাহীন স্মৃতি।