কক্সবাজার। নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অপার সমুদ্রের দৃশ্য, যেখানে নীল জলরাশি আকাশের সাথে মিলে একাকার হয়ে গেছে। বালির সৈকত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শান্তি, সমুদ্রের গর্জন, আর পাহাড়ের সবুজ চাদরে ঢাকা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য—এই সব মিলিয়েই কক্সবাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রিয় পর্যটন গন্তব্য। আর এই কক্সবাজারের হৃদয় জুড়ে রয়েছে এক অনন্য সড়ক, যার নাম মেরিন ড্রাইভ। এটি শুধু একটি রাস্তা নয়, এটি এক জীবন্ত কবিতা, যা সমুদ্রের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে, প্রকৃতির সৌন্দর্যকে বুকে ধরে।
কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত হিসেবে পরিচিত। এই সৈকতের সৌন্দর্যকে আরও কাছ থেকে উপভোগ করার জন্য মেরিন ড্রাইভ (Marine drive cox bazar) এক বিস্ময়কর রাস্তা । এটি কক্সবাজার শহর থেকে শুরু হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি মনোমুগ্ধকর রাস্তা, যা একপাশে নীল জলরাশি আর অন্যপাশে সবুজ পাহাড়ের অনন্য সমন্বয়ে তৈরি এক অপার সৌন্দর্যের দৃষ্টান্ত।
মেরিন ড্রাইভ রোডে গাড়ি চালানোর সময় মনে হবে আপনি প্রকৃতির এক গভীর আলিঙ্গনে আছেন। সমুদ্রের বাতাস, ঢেউয়ের গর্জন, আর চারপাশের অপূর্ব প্রকৃতির শোভা যেন পর্যটকদের এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়। চলুন, বিস্তারিত জানি মেরিন ড্রাইভ (Marine drive cox bazar) ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, সুবিধা, দর্শনীয় স্থান, খাবার, আবাসন ও ভ্রমণ সংক্রান্ত পরামর্শ সম্পর্কে।
মেরিন ড্রাইভ (Marine drive cox bazar): কেন এত জনপ্রিয়?

মেরিন ড্রাইভ শুধুমাত্র একটি রাস্তা নয়, এটি এক অনন্য ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। এর সৌন্দর্য দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। সকালে সূর্যোদয়ের সময় সমুদ্রের জলরাশি সোনালি আলোয় ঝলমল করে, আর বিকেলে সূর্যাস্তের সময় আকাশ রঙিন হয়ে ওঠে। রাতের বেলা এই রাস্তা ধরে চলার সময় আপনি সমুদ্রের গর্জন এবং চাঁদের আলোয় ঝলমলে জলরাশি দেখে মুগ্ধ হবেন। পর্যটকদের কাছে এটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় হওয়ার কারণ:
- সরাসরি সমুদ্রের পাশে অবস্থিত – এই রাস্তায় ভ্রমণ করলে সমুদ্র যেন হাতছোঁয়া দূরত্বে থাকে। ঢেউয়ের শব্দ আর নীল জলের অবিরাম দৃশ্য আপনাকে বিমোহিত করবে।
- চমৎকার দৃশ্যপট – একপাশে বিশাল সমুদ্র আর অন্যপাশে সবুজ পাহাড়, যা বাংলাদেশে বিরল।
- সুবিধাজনক রাস্তা – কক্সবাজার শহর থেকে সহজেই যাওয়া যায়, রাস্তা মসৃণ ও মনোরম।
- বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান – ইনানি, হিমছড়ি, প্যাঁচার দ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফসহ অসংখ্য পর্যটন স্পট এই রাস্তায় অবস্থিত।
- সানসেটের অসাধারণ দৃশ্য – মেরিন ড্রাইভের নির্জন সৈকত থেকে সূর্যাস্ত দেখার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ।
মেরিন ড্রাইভ (Marine drive cox bazar) রোড কোথা থেকে কোথায়?
মেরিন ড্রাইভ রোড কক্সবাজার শহর থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি একপাশে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে এবং অন্যপাশে সবুজ পাহাড়কে সঙ্গী করে এগিয়ে গেছে।
রাস্তার শুরু হয় কক্সবাজার শহরের কলাতলি পয়েন্ট থেকে। এরপর পর্যটকরা চাইলেই নির্দিষ্ট দূরত্বে বিভিন্ন পর্যটন স্থান ঘুরে দেখতে পারেন, যেমন:
- হিমছড়ি (১২ কিমি) – পাহাড় ও জলপ্রপাত
- ইনানি বিচ (২৫ কিমি) – সোনালী বালির সৈকত
- শামলাপুর সৈকত (৫০ কিমি) – নির্জন সৈকত
- সাবরাং পর্যটন এলাকা (৭০ কিমি) – সমুদ্রের সৌন্দর্যে ঘেরা
- টেকনাফ (৮০ কিমি) – নাফ নদীর তীরে অবস্থিত
মেরিন ড্রাইভে দর্শনীয় স্থান ও অভিজ্ঞতা
১. হিমছড়ি: পাহাড়ি ঝর্ণার মায়াবী সৌন্দর্য
মেরিন ড্রাইভের (Marine drive cox bazar) এক অন্যতম আকর্ষণ হিমছড়ি। এটি কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ১২ কিমি দূরে অবস্থিত। এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট, যার প্রধান আকর্ষণ হল এর জলপ্রপাত এবং পাহাড়ি ঝর্ণা। হিমছড়ির পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে বয়ে চলা জলধারা আপনাকে প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ করবে। এখানে আপনি পাহাড়ি ঝর্ণায় গোসল করতে পারবেন এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে পারবেন।
২. ইনানী বিচ: নির্জনতার সন্ধানে
কক্সবাজারের অন্যতম সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন সৈকত ইনানি বিচ। এটি শহর থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে এবং এখানে সোনালী বালি ও নানা আকৃতির প্রবাল পাওয়া যায়। এটি একটি নির্জন এবং সুন্দর সৈকত, যেখানে আপনি সমুদ্রের শান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন। ইনানী বিচের বালি সাদা এবং মসৃণ, যা পর্যটকদেরকে আকর্ষণ করে। এখানে আপনি সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পারবেন এবং সমুদ্রের শান্ত পরিবেশে সময় কাটাতে পারবেন।
৩. শামলাপুর সৈকত
যারা নির্জনতা পছন্দ করেন, তাদের জন্য শামলাপুর সৈকত এক অনন্য স্থান। এখানে পর্যটকের ভিড় তুলনামূলক কম, তাই আপনি শান্তিপূর্ণভাবে সমুদ্র উপভোগ করতে পারবেন।
৪. সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক
মেরিন ড্রাইভ (Marine drive cox bazar) ধরে এগিয়ে গেলে সাবরাং এলাকায় বিশাল পর্যটন স্পট রয়েছে। এখানকার সাবরাং বিচ অত্যন্ত সুন্দর এবং পরিবারের সঙ্গে কাটানোর জন্য চমৎকার জায়গা।
৫. টেকনাফ: বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের প্রান্ত ও নাফ নদী
মেরিন ড্রাইভের শেষ গন্তব্য টেকনাফ, যা কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের স্থান, যার প্রধান আকর্ষণ হল এর সমুদ্র সৈকত এবং নাফ নদী। টেকনাফে আপনি নাফ নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন এবং সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। এখানে আপনি স্থানীয় সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
৬. সোনাদিয়া দ্বীপ: প্রকৃতির নির্জন আবাস

By Zislam1968 – সিসি বাই-এসএ ৪.০, সংযোগ
সোনাদিয়া দ্বীপ কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এটি একটি নির্জন এবং সুন্দর দ্বীপ, যেখানে আপনি প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। সোনাদিয়া দ্বীপে আপনি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে পাবেন, যা পাখি পর্যবেক্ষকদের জন্য একটি আদর্শ স্থান। এখানে আপনি সমুদ্রের শান্ত পরিবেশে সময় কাটাতে পারবেন এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যে মুগ্ধ হবেন।
মেরিন ড্রাইভে খাওয়া-দাওয়া ও হোটেল

সেরা রেস্টুরেন্ট
মেরিন ড্রাইভ (Marine drive cox bazar) এর পাশে বেশ কিছু ভালো মানের খাবারের দোকান ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেখানে তাজা সীফুড ও স্থানীয় খাবার পাওয়া যায়। কিছু জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট হলো:
- Mermaid Cafe – সুগন্ধা বীচের কাছে এই রেস্টুরেন্টটিতে বিভিন্ন সামুদ্রিক খাবার পাওয়া যায়।
- মেরিন ফিশ ক্যাফে এন্ড রেস্টুরেন্ট – মেরিন ড্রাইভের কাছে অবস্থিত, সীফুড ও সামুদ্রিক মাছের জন্য জনপ্রিয়।
- মেরিন ড্রাইভ রেস্টুরেন্ট – মেরিন ড্রাইভের কাছে এই রেস্টুরেন্টটিতে লোকাল খাবারের স্বাদ গ্রহন করতে পারবেন মেরিন ড্রাইভের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে।
সেরা হোটেল
যারা মেরিন ড্রাইভের আশপাশে থাকতে চান, তাদের জন্য কিছু ভালো মানের হোটেল হলো:
- সী গাল হোটেল (কক্সবাজার) – ৫ স্টার মানের বিলাসবহুল হোটেল।
- সায়মন বিচ রিসোর্ট – ইনানি বিচের কাছে অবস্থিত।
- ইনানি রয়েল রিসোর্ট – ইনানি সৈকতের খুব কাছে।
- ওশান প্যারাডাইস হোটেল – সমুদ্রের অসাধারণ ভিউ সহ একটি বিলাসবহুল হোটেল।
- টেকনাফ গেস্ট হাউস – যারা টেকনাফ ঘুরতে চান, তাদের জন্য ভালো অপশন।
কেন মেরিন ড্রাইভে ঘুরবেন?
- প্রাকৃতিক সৌন্দর্য – একসঙ্গে সমুদ্র ও পাহাড় উপভোগ করার একমাত্র সুযোগ।
- সড়ক ভ্রমণের আনন্দ – রাস্তাটি এত সুন্দর যে এটি নিজেই একটি পর্যটন স্পট।
- ফটোজেনিক লোকেশন – ফটোগ্রাফির জন্য দারুণ সব লোকেশন রয়েছে।
- বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র একসাথে দেখার সুযোগ – একসাথে হিমছড়ি, ইনানি, সাবরাং, টেকনাফ ঘুরে দেখা সম্ভব।
ভ্রমণকারীদের জন্য টিপস
- সঠিক সময় বাছাই করুন – মেরিন ড্রাইভ (Marine drive cox bazar) ভ্রমণের জন্য সকাল বা বিকেলের সময় নির্বাচন করুন। এই সময়ে সমুদ্রের দৃশ্য সবচেয়ে সুন্দর হয় এবং আবহাওয়া সহজেই সহনীয় থাকে।
- গাড়ির ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন – ব্যক্তিগত গাড়ি বা রিজার্ভ সিএনজি ব্যবহার করলে সুবিধা হবে। এছাড়াও মেরিন ড্রাইভ ভ্রমণের জন্য আপনি গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। স্থানীয় ট্যুর অপারেটরদের কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া করা যায়।
- প্রয়োজনীয় জিনিস সাথে রাখুন – ভ্রমণের সময় পানি, স্ন্যাকস, সানস্ক্রিন এবং ক্যামেরা সঙ্গে রাখুন। সমুদ্রের পাশে থাকার কারণে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা জরুরি।
- নিরাপত্তা বজায় রাখুন – নির্জন স্থানে বেশি রাতে একা যাওয়া এড়িয়ে চলুন। পরিবেশ সংরক্ষণের দিকে খেয়াল রাখুন। প্লাস্টিকের বোতল বা অন্যান্য বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকুন।
- স্থানীয় গাইড – যদি আপনি স্থানীয় গাইড নিয়ে ভ্রমণ করেন, তাহলে আপনি আরও ভালোভাবে দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং ভ্রমণটি আরও উপভোগ্য হবে।
মেরিন ড্রাইভ কেবল একটি রাস্তা নয়, এটি প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি, যা পর্যটকদের স্বপ্নের মতো ভ্রমণ অভিজ্ঞতা দেয়। যারা কক্সবাজার বেড়াতে যান, তাদের অবশ্যই একবার মেরিন ড্রাইভ (Marine drive cox bazar) ধরে একটি ট্রিপ দেওয়া উচিত। সূর্যাস্তের আলোয় নীল জলরাশির সৌন্দর্য দেখতে চাইলে এটি আপনার জন্য পারফেক্ট জায়গা!
এখনই পরিকল্পনা করুন, ব্যাগ গুছিয়ে নিন, আর বেরিয়ে পড়ুন মেরিন ড্রাইভের সৌন্দর্য উপভোগ করতে!
মেরিন ড্রাইভ ভ্রমণ: বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. মেরিন ড্রাইভ কোথায় অবস্থিত?
মেরিন ড্রাইভ কক্সবাজার শহর থেকে শুরু হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি সুন্দর রাস্তা, যা বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে তৈরি হয়েছে।
২. মেরিন ড্রাইভ (Marine drive cox bazar) রোডের মোট দৈর্ঘ্য কত?
মেরিন ড্রাইভ রোডের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার।
৩. কিভাবে মেরিন ড্রাইভে যাওয়া যায়?
আপনি কক্সবাজার শহর থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি, মাইক্রোবাস বা বাইক ভাড়া করে সহজেই মেরিন ড্রাইভে যেতে পারেন।
৪. মেরিন ড্রাইভ (Marine drive cox bazar) যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময় কোনটি?
নভেম্বর থেকে মার্চ (শীতকাল) মেরিন ড্রাইভ ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়, কারণ তখন আবহাওয়া শুষ্ক ও মনোরম থাকে।
৫. মেরিন ড্রাইভে প্রবেশের জন্য কোনো টিকেট লাগে?
না, মেরিন ড্রাইভে প্রবেশের জন্য কোনো টিকেট লাগে না। তবে কিছু বিশেষ পর্যটন স্থানে প্রবেশের জন্য ফি থাকতে পারে।